মোঃ সাইদুর রহমান:
অকাল বন্যায় ভেসে গেছে মৎস চাষীদের মাছ, ফসলি জমি সহ সবজিক্ষেত,পানির নীচে, সাত জেলায় বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও ফিসারি।বাহারি শিরোনামে পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছিল। এ মাসের প্রথম দিকে ২৪ ঘন্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছিল ফসলি জমি সহ মৎস খামার।
ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বলতে পৃথিবীতে সাম্প্রতিক কালের মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনকেই বোঝানো হয়। এর প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ ও বাতাসসহ বিভিন্ন সূচকের পরিবর্তন হয় ও পৃথিবীপৃষ্ঠে তার নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে । বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অনাবৃষ্টি, অকালবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারন।
কিন্তু এ মাসের অকাল বন্যাকে আমি বন্যা বলবো না। এটাকে আমি জলাবদ্ধতা বলবো। এর অন্যতম কারন নদী,খাল বিলশাসন। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সারা দেশে জালের মতো জড়িয়ে আছে নদী গুলো। নদী এবং বাংলাদেশের মধ্যে নিবিড় ও অঙ্গ জুড়ানো সম্পর্ক। দেশ আমাদের মাতৃতুল্যা হলে, নদীগুলো হলো আমাদের মায়ের প্রবাহিত রক্ত শিরা- উপশিরা। রক্ত প্রবাহে যেমন বাধা পড়লে শরীরের অশুভ সংকেত আসে, তেমনি নদী দখল ও দূষণ হলে বাংলাদেশের জলবায়ু ও পরিবেশে অশুভ ছায়া প্রকৃতির রক্ত চক্ষুর বহিঃপ্রকাশ।যারফলে দেশের ৭ টি জেলা আজ জলাবদ্ধতায় প্লাবিত।
প্রাচীন সংস্কৃতি, সভ্যতা, ব্যবসা- বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল নদী কেন্দ্রীক। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠতেছে নদীর বুকে ধ্বংস লিলা খেলে। নদীর প্রবাহবান ধারায় গিটগিটির মতো দখলবাজরা পরিবর্তিত রূপে নদী দখলে বেসামাল। কেউ দলীয় পরিচয়ে, কেউ ক্ষমতার দাপটে, কেউ কালো টাকার গরমে, আবার কেউ আবাসন বা নগরায়ের নামে বিল-ঝিল, জলাশয় দখল করে কাগজ কলমে। ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরের আশেপাশের বিল-ঝিল, জলাশয় ভরাট করে বিক্রির নজরকারা বিজ্ঞাপনও দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচরে পড়ে না!
নদী দখলকারীদের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে, আর পরিবেশ হারাচ্ছে ভারসাম্য। অভিশপ্ত হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। বাংলার হাজারের বছরের ঐতিহ্য বিপন্ন হচ্ছে, বিপন্ন হচ্ছে প্রাণীকুল। নদী তার স্বাধীনতা হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে । নদীর বিষাক্ত পানির ছোবলে পাল তুলা নৌকা আর ভাটিয়ারী সূর পরাস্হ ও নিস্তেজ। অন্যদিকে আইপিসিসি উদ্ভাবিত জলবায়ুর মডেল নির্দেশনা বলে, আগামী ২০৩০সালে বাংলাদেশে ১৫ ভাগ বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাবে। টাস্কফোর্স এর প্রতিবেদনের ভবিষ্যৎবাণী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে প্রায় ২২.৮৮ বর্গকিমি ভূমি সমুদ্র গর্ভে হারিয়ে যাবে। এই হিসাবে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৫.৮%সমুদ্রজলে তলিয়ে যাবে!
নদীর স্বাধীনতাকে যারা পদদলিত করছে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। স্বাধীনতার কাল জয়ী স্লোগান “তোমার আমার ঠিকানা পদ্ম, মেঘনা, যমুনা। ” আজ বাকরোদ্ধ ও নির্বাক। যে স্লোগানের দেশত্ববোধের মধুরটানে দেশের মানুষ হাসিমুখে জীবন দিয়েছিল। সেই স্লোগানের নদীগুলোকে খাবলে খাবলে দখল করছে শুকুনের দলেরা! শহীদদের প্রেতাত্মা আজ অবাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্লোগানের মর্মকথা কেন বাঙালী জাতির মর্ম ধ্বনিতে জলোচ্ছ্বাস তুলে না? নদীর স্বাধীনতা রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও রুটিন কাজ।
নদী রক্ষার জন্য সাথে ২৭ টি মন্রণালয় ও বিভাগ জড়িত। আছে নদীরক্ষা কমিশন, আছে সরকারী জেলা নদী রক্ষা কমিটি, উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি। এত মন্ত্রণালয়! এত কমিটি! তারপরও গত সাড়ে চার দশকে অর্ধেক নদীর অস্তিত্ব নাই। আনন্দ বাজার পত্রিকার তথ্যমতে বাংলাদেশে নদী প্রায় ১৩০০ টি। বর্তমানে নদী আছে প্রায় ৭০০ টি। মাধ্যমিক ভূগোল ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে নদী আছে এখন ৩০০টি। প্রায় সাড়ে চার হাজার কিঃ মিঃ নদী নাব্যতা হারিয়েছে। বর্তমানে প্রবাহবান নদী গুলো স্রোতস্বিনী ও উচ্ছ্বলতা হারিয়ে দিনে দিনে মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে, নদী গুলোর গতিধারা। ভূমি দস্যুদের লোলুপ দৃষ্টির জন্য নির্যাতিত হচ্ছে নদীগুলো । এ ভাবে চলতে থাকলে হয়তোবা নদীমাতৃক দেশ আর খোঁজে পাবনা! অন্যদিকে প্রতিবছর বানভাসি মানুষের সামান্য আশ্রয় আর খাবারে জন্য শুনতে হবে আর্তনাদ।
নদী রক্ষায় রাষ্ট্র আছে, মন্রণালয় আছে, আইন আছে। আইনের প্রয়োগ কালো চশমার বেড়াজালে আটকাও পড়ে আছে। কিছু সাহসি অফিসাররা নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে সাহসি উদ্যোগ নেন। কিন্তু বদলী আর হয়রানী তাঁদের জন্য অবধারিত।নদী দখলদাররা যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছত্রছায়ার চলে যায়। সরকার বা রাষ্ট্রকে নদী রক্ষার আরও মনোযোগী হতে হবে।২০১৯ সালে নদীকে ” জীবন্ত সত্তা ” হিসাবে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। নদীর অবৈধ দখলদার ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষমতাধর। আইনের বাণী তাদের কাছে কচু পাতার পানি।বর্তমান সরকার নদীর অবৈধ স্হাপনা উচ্ছেদ অভিযান স্বল্পকালীন হলেও প্রশংসার দাবীদার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নদী দখল মুক্ত করার জন্য অনেকবার নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু সমন্বয়হীনতার জন্য নদীগুলো আজ পরাধীন। নদী রক্ষায় আইনের প্রয়োগ স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে। নদী কমিশন, কমিটি, হাইকোর্টের রায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা।প্রতিবছর নদী রক্ষায় বিভিন্ন মন্রণালয়ে বাজেটে অনুদানের কমতি থাকে না! কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এর প্রতিফলন ঘটে যৎ সামান্য।
নদী দখলের জন্য ফেলা হচ্ছে পরিবেশের অবাঞ্ছিত বর্জ্য, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, পৌর- কর্পোরেশনের ময়লা। নদীর দু’পাড়ের গাছ কেটে উজার করছে বনভূমি।নদীতে অপরিকল্পিত ভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। শিল্প কারখানার তরল রাসায়নিক পদার্থ নদীতে ফেলার ফলে, নদীর পানি হচ্ছে বিষাক্ত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রতিদিন শুধু বুড়ীগঙ্গাতেই ২২ হাজার ঘনমিটার তরল এবং ১০ মেট্রিকটন কঠিন বর্জ্য ফেলা হয়। নদীতে বাঁধ, স্লুইসগেট নির্মাণ, গতিরোধ, বর্জ্য ফেলার ফলে নদীতে পলি জমা হচ্ছে এবং নদ-নদী বুকে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত চর। আর অল্প বৃষ্টি বা পাহাড়ী ঢলে প্লাবিত হচ্ছে দেশের অধিকাংশ জেলা। নদী কেন্দ্রীক উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়ার আগে রাষ্ট্রকে জননিরাপত্তা নিয়ে ভাবা উচিৎ।
কবি গুরু লিখেছিলেন,
” আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।” সবগুলো নদীই এখন অর্ধমৃত। বেপরোয়া নদী দখল ও দূষণ সহ হাজারও সমস্যায় জর্জরিত আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদী গুলো। আমাদের নদী গুলো প্রাকৃতিক সম্পদের অমূল্য ভান্ডার। নদী বাঁচলে কৃষি বাচঁবে, উদ্ভিদ বাঁচবে, পরিবেশের ভারসাম্য ফিরে পাবে, দেশের প্রাণীকুল বিলুপ্তির পথ থেকে রক্ষা পাবে আর অতিখড়া, অতিপ্লাবন থেকে বাঁচবে দেশের সমতল ভূমি।
নদী রক্ষার জন্য সুপারিশের কোন ঘাটতি ছিল না, শুধু অন্ধ ছিল বাস্তবায়ন শব্দটি। নদী রক্ষার জন্য বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। নদী রক্ষার জন্য দেশব্যাপী একটা বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন চাই। নদীর সীমানা রক্ষায় সীমানা পিলার নির্মাণ করতে হবে। নদী কমিশনকে দুদকের মতো স্বাধীন করে দিতে হবে।নদী রক্ষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জনসচেতনতা মূলক প্রচার জোড়দার করতে হবে। নদীতে যে কোন ধরনের ময়লা-আবর্জনা ফেলা আইনগত ভাবে বন্ধ করতে হবে।নদী বান্ধব অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্হা চালুর জন্য, খড়া মৌসুমে যত সম্ভব অভ্যন্তরীণ নদীগুলোকে পুনঃখনন, সংস্কার ও পুনগঠন ও দখল মুক্ত করতে হবে। শিল্পকারখানায় ২৪ ঘন্টা ইটিপি চালু রাখতে হবে। অবৈধ স্হাপনা উচ্ছেদ করতে হবে এবং নতুন করে দখল রোধে মনিটরিং জোড়দার করতে হবে।
পরিশেষে নদীর নাব্যতা সংকট দূর করতে না পাড়লে, বন্যার মতো প্রকৃতি দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়বে না।
” আমাদের নদী আমরাই হবো রক্ষক। ”
মোঃ সাইদুর রহমান, লেখক ও কলামিস্ট
নান্দাইল, ময়মনসিংহ।