সিনিয়র রিপোর্টার:
রোববার (১৯ নভেম্বর) সকালে ‘হোটেল রেডিসন ব্লু’তে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই-ফিকি) -এর ৬০ বছর পূর্তি উদযাপন এবং দু’দিন ব্যাপী ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০২৩ এর উদ্বোধনকালে দেওয়া প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।
আমরা সারাদেশে একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ৩৯টি হাই-টেক পার্ক প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করেছি, এগুলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এককভাবে কোনো দেশ যদি এক খণ্ড জমি চায় আমরা তাও দেব। আবার যদি কেউ যৌথ উদ্যোগে করতে চান সেটাও করা হবে অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে করতে চাইলে সেটাও করা হবে।
তিনি বলেন, তার সরকার অনেকগুলো সংস্থা তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), বাংলাদেশ ইকোনমিক প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি (এইচটিপিএ) এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপিএ)। বিনিয়োগের সুবিধার্থে বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে ওয়ান স্টপ পরিষেবা চালু করা হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, বিনিয়োগ পরিষেবা প্রদানকারী সব অফিস সম্পূর্ণ অনলাইন এবং ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। একইসাথে কর মওকুফ, রেমিটেন্স রয়্যালটি, প্রস্থান নীতি, লভ্যাংশ এবং মূলধন সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন, আইন দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষাসহ বিনিয়োগ নীতিকে আরও সহজ করার জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, তার সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এ সরবরাহ খাত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংশ্লিষ্ট খাত এবং পর্যটন খাতকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
‘ব্লু-ইকোনমি’র প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ব্লু-ইকোনমি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমরা নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। লজিস্টিক শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে অন্যান্য শিল্প খাতের উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে জাতীয় লজিস্টিকস ডেভেলপমেন্ট পলিসি প্রণয়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশে এখন জ্বালানি, পানি, লজিস্টিকস এবং পরিবহন খাতে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো গড়ার সুযোগ রয়েছে।’
২০২৫ সালের মধ্যে শুধু লজিস্টিকস খাতই ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ও শক্তিশালী রপ্তানি কৌশল এবং শিল্পনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে জিডিপি-তে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত করতে চাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন প্রায় সতেরো কোটি মানুষের একটি বড় অভ্যন্তরীণ বাজার। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির মতো প্রতিষ্ঠিত বাজারগুলোকে এবং বর্তমান উচ্চ-প্রবৃদ্ধির ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডকে আমাদের দেশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, “আমাদের এই ধারাবাহিক উন্নয়নের যাত্রায় ফিকি’র প্রতিটি সদস্যদের নিরলস প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে এই ধারা আমাদেরকে বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে সকলের সামনে তুলে ধরবে। একইসাথে, দেশের অভ্যন্তরে প্রতিভার মুল্যায়ন ও সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখা সকল বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “সফলতার ৬০ বছরে ফিকির এই পদার্পণকালে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ফিকির সকল সদস্য ও সম্মানিত স্টেকহোল্ডারদের যাদের নিরলস প্রচেষ্টায় আজ এই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। দেশে এখন ১০০টিরও বেশি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা হয়েছে এবং বিগত বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ২০ শতাংশ বেশি এফডিআই আসবে বলে আমরা সকলে আশাবাদী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গঠনে এবং ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে ফিকি কাজ করে যাচ্ছে এবং আগামীতেও এই ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখবে।”
ফিকি’র সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, “জাতির পিতার আদর্শে লালিত ফিকি-এর প্রতিটি সদস্য বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এই দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে নিজেদের অংশীদ্বারত্বকে স্থায়ী করে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ফিকি-এর সদস্যরা প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে ফিকি-এর অবদান অনেক এবং উন্নত দেশের লক্ষ্য অর্জনে ফিকি-এর ভবিষ্যত প্রতিশ্রুতি অটল থাকবে।”
ফিকি’র সহ-সভাপতি দীপল আবেউইক্রমা বলেন, “আমি গর্বিত যে, গত ছয় দশকের গৌরবময় যাত্রায় ফিকি এবং এই সংস্থার সদস্যরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিশ্বের ৩৫টি দেশ থেকে ২১টি ব্যবসায়িক খাতে এফডিআই অর্জন করেছে। আমি আশা করি, এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে আমাদের ধারণা বিনিময় ও মূল খাতগুলোকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে। এছাড়াও, এর মাধ্যমে নিত্যনতুন সমস্যার সমাধান, উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ এবং নতুন অংশীদারিত্ব তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। আমাদের এই উদযাপনের মূললক্ষ্য হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ প্রদান করা।”
এই অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া।বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী কয়েকজন আন্তর্জাতিক সফল বিনিয়োগকারীও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে ‘গ্রিন ভ্যালু চেইন’ শীর্ষক একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনের প্রধান অতিথি ছিলেন স্মার্ট বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক-এর সহ-সভাপতি এবং প্রাক্তন মূখ্য সচিব ও মূখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) মো: আবুল কালাম আজাদ। আরও উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এর উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান; ফিকি’র ইএসজি কমিটি’র সভাপতি ও পরিচালক জাভেদ আখতার; বিল্ড-এর সভাপতি ও এমসিসিআই-এর প্রাক্তন সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির; বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-এর (বিডা) আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রচার বিভাগের সদস্য-৩ মোহসিনা ইয়াসমিন; ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার মো: সমীর সাত্তার; ইউএনডিপি’র আঞ্চলিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার; গ্রামীণফোন-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান প্রমুখ।
সেমিনারে কৃষি জমির ক্ষতি, পানীয় জলের অভাব এবং ঘূর্ণিঝড়-সহ বিভিন্ন জলবায়ু ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, “প্রতিকূল জলবায়ু পরিস্থিতি জনিত অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এছাড়াও, এই পরিস্থিতি সামলে উঠতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।” তিনি তার বক্তব্যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বহিরাগত অর্থায়ন ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগের উপর জোর দেন এবং কার্বন কর আরোপ করার পরামর্শ দেন।
সেমিনারটিতে দেশে সামগ্রিক পণ্য ও পরিষেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ খাতে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি জোর আরোপ করা হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব করাই ছিলো এই অধিবেশনের আলোচ্য বিষয়।
ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, “একটি পণ্য বাজারজাত ও বিক্রি করার পর এর ব্যবহার নিয়ে আমরা সজাগ থাকি না, যা কিছু কিছু পরিবেশ দূষণকারী বর্জ্যে পরিণত হয়। গুণগত মান রক্ষা করে পণ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।”
সেমিনারের প্রধান অতিথি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “ইএসজি ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে সবুজ ও সমৃদ্ধ পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। যদি সকল ক্ষেত্র থেকে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সকলে কাজ করে যাচ্ছে, তবুও আমি মনে করি সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্র থেকে এই বিষয়টিকে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা দরকার। এতে করে ভবিষ্যত প্রজন্ম এই ব্যাপারে সজাগ থাকবে এবং গবেষণালব্ধ নিত্যনতুন ধারণা পাওয়া যাবে।”