শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৪ অপরাহ্ন
বিজ্ঞপ্তি
শেখ রাসেল ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের নয়নমণি 
/ ৭৪ Time View
Update : বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৩, ১:০৭ অপরাহ্ন

সাইদুর রহমান ,ময়মনসিংহ:

১৯৬৪ সাল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে উৎকন্ঠা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে চরম উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধু আইয়ুব বিরোধী প্রচারণায় বলিষ্ঠ কন্ঠই তার ব্যস্ততাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দিন-রাত যখন প্রচারণায় একাকার হয়ে গেছে, তখন বিশ্রাম বঙ্গবন্ধু কাছে পরাস্থ ও পরাভূত। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান আইয়ুবের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধু’র শরীর ও মনে ক্লান্তির অপূরনীয় চাপ ছিল।

হয়তোবা সৃষ্টিকর্তা তাঁর ক্লান্তিকে দূরীভূত করার জন্য তাঁর পরিবারে সবাই ১৮ অক্টোবরে অন্য খবরের অপেক্ষায় সবাই ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর বাড়িতে অপেক্ষারত। পরিবারের সবাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা তাঁদের চাচার বাসায়। পরিবারের সবাই উৎকন্ঠা আর অপেক্ষার মুহূর্তে চিন্তাযুক্ত। শেখ হাসিনার বড় ফুফু আর মেজো তাঁর মার সাথে। একজন ডাক্তার আর নার্স এসেছেন। পরিবারের সবার কাছে মিনিট তখন ঘন্টার সমান। সবাই ঘুম চোখে, চোখের পাতা টেনে জেগে আছেন। কখন দরজা খোলে নতুন অতিথির আগমনের বার্তা পাবেন। তাঁদের মেজো ফুফু হাসি মুখে দরজা খোলে বললেন ” তোমাদের ভাই হয়েছে। ” সবাই খুশির অট্রালিকা পেযেছিল। সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাঙ্ক্ষিত অতিথিকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে পড়লো। ফুফু বললেন, অপেক্ষা কর ডাকবো । কিছুক্ষণ পর বড় ফুফু সেই প্রত্যশার চাঁদকে শেখ হাসিনার কোলে তুলেন দিলেন। বড় বোনের মনে হয়েছিল তাঁর কোলে সোনার পুতুল তুলে দিয়েছে । ছোট্ট ছোট্ট মুষ্টিবদ্ধ হাত-পা আনন্দ হাসিমাখা মুখমন্ডল সবার মন প্রাণ ছুঁয়ে ছিল। আর পরিবারে সবাই অপলক দৃষ্টিতে নয়ন জড়ানো অতিথিকে নয়ন ভরে দেখলেন। সবাই ঈদের চাঁদকে আদর সোহাগে ভরে দিলেন।

” তাঁর মায়াবী চেহারা, কোমল দেহ, ঘন কালো চুল, তুলতুলে নরম গাল, বেশ বড় সড় হয়েছিল ”

( শেখ হাসিনা, আমাদের ছোট রাসেল সোনা)

বাঁধহীন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে বঙ্গবন্ধু পরিবার । পিতা বঙ্গবন্ধু শিশুটিকে চুমু খেয়ে অভিষিক্ত করলেন তাঁর বিশাল বক্ষে। তারপর উচ্চারণ করলেন – ” ওর নাম হবে রাসেল।” বঙ্গবন্ধু দেশী-বিদেশী লেখকের বই পড়তেন। তাঁর প্রিয় লেখক, খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেল এর নামানুসারে পরিবারের নতুন অতিথির নাম দেন রাসেল। শেখ রেহেনার জন্মের আট বছর পর শেখ রাসেলের জন্ম হয়।এরপর থেকে রাসেল নামটি পরিবারের কাছে তৃপ্তির মহাঔষধ। রাসেল তখন সর্বকনিষ্ঠ। সবাই রাসেলকে নিয়ে অভিন্ন পরিকল্পনায় ব্যতিব্যস্ত। এ ভাবেই রাসেল পরিবারে সকলের আদর সোহাগে বেড়ে উঠতে থাকে। রাসেলের একটু কান্না মনে হয়, সবার বুকফাটা আর্তনাথের কারন হয়ে দাঁড়ায় । শিশু রাসেল বঙ্গবন্ধু পরিবারের নয়নমণি। সময় যাচ্ছে, দিন যাচ্ছে, বছর অতিবাহিত হচ্ছে। রাসেল বড় হচ্ছে শেখ পরিবারের অত্যন্ত আদরের সন্তান হিসাবে। ছোটকাল থেকেই রাসেল প্রাণবন্ত ও চঞ্চল ছিল।

রাসেল বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবাকে কাছে পেলেই বুকে ঘুমানোর সুযোগটা হাতছাড়া করতেন না। রাজনৈতিক কারনে তাঁর বাবাকে কাছে পাওয়া বা জড়িয়ে বাবা ডাকা কঠিন ছিল। রাসেল বাবাকে কাছে না পাওয়ায় বেশ অভিমান করতো। বঙ্গবন্ধু’র কারাগার ছিল প্রথম বাসা। রাসেল মনে করতেন আমার বাবা ওখানেই থাকেন। বাবার অবর্তমানে

মাকে বাবা বলে ডাকতেন। কারাগারে রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ” জেলগেটে উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আর বাইরে এসো দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। যখন রুমের ভিতর যেয়ে কোলে করলাম আমার গলায় ধরে আব্বা আব্বা করে ডাকতে শুরু করল। আবার ওর মাকে আব্বা বলে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম ব্যপার কি? ওর মা বলল, বাড়িতে আব্বা আব্বা বলে কাঁদে তাই ওকে আমাকে আব্বা বলে ডাকতে বলেছি । রাসেল আব্বা বলে ডাকতে লাগলো। যেই আমি জবাব দেই, সেই তার মার গলা ধরে বলে ‘ তুমি আমার আব্বা ‘। ছেলের আমার উপর অভিমান করেছে মনে হয়।

শেখ রাসেল’র মাত্র দেড় বছর বযস থেকেই তাঁর পিতার সাথে সাক্ষাতের একমাত্র স্থান হয়ে উঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। তখন থেকেই রাসেল ভাবতেন আমার বাবা বাড়ি এটাই এবং এখানেই থাকেন। ” ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না আমাকে না দেখা পযর্ন্ত। ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পযর্ন্ত শুধু জানালায় দিকে চেয়ে থাকে বলে, আব্বার বাড়ি। ওর ধারণা এটা ওর আব্বার বাড়ি।” (সূত্র / কারাগারের রোজনামচায়)

বঙ্গবন্ধু’র রাজবন্দী হিসাবে কারাবাস তাঁর নিত্যদিনের। পিতার সান্নিধ্য, স্নেহ-মমতা, বুকে ঘুমানোর আশা যখন কারাগারে বন্দি। তখন তাঁর সকল চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্র বিন্দু মা। বাবার ভালোবাসা পাওয়া ছিল রাসেল কাছে অপেক্ষার লম্বা সময়। ভাইবোনদের নয়নের মধ্যমণি রাসেল বাবার আদরের অভাবি ছিল। কারাবন্দি পিতার জীবনযাপন রাসেলকে মর্মাহত করেছিল, তাই পিতার সামনেই মাকে বাবা বলে ডাকতেন। কারাগারে দেখা করতে গেলে মুখ গোমড়া করে রাখতেন।

বঙ্গবন্ধু কারাবাস, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা, পরিবারের সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেন। শেখ রাসেল একাকী হয়ে উঠেন। তখন তাঁর প্রিয় সঙ্গী ছিল সাইকেল আর কবুতর।

 

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে তাঁর চার বছরের রাসেলকে কোলে তুলে নেন। বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেন। এই প্রথম রাসেল তাঁর মনপুত পিতার আদর সোহাগ পেয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে। পাকিস্তানিরা যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন বঙ্গবন্ধু পরিবারকে ধানমন্ডির ১৮ সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি করে৷ তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি আর রাসেল দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। তাঁর মা ও দুই আপাসহ পরিবারে সদস্যরা বন্দি জীবন কাটিয়ে ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত হন। ৭ বছরের রাসেল তখন জয় বাংলা বলে ঘর থেকে বাইরে চলে আসেন।

রাসেল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী ছিলেন। দুরন্ত ছিলেন পাশাপাশি মেধাবী। শেখ রাসেল স্কুলের সহপাঠীদের সাথে মিলেমিশে থাকতেন। খেলার সাথী হিসাবে সাইকেল প্রিয় ছিল। আর ভাগ্নে জয়। ভাগ্নে জয়ের সাথে খুনসটিও করতেন, আবার জয় না হলে তাঁর চকলেট খাওয়া, খেলা হতো না। প্রকৃতি ও পাখিকে ভালোবাসতেন। কবুতরও ছিল তাঁর প্রিয় পাখি।

শেখ রাসেলে’র গৃহশিক্ষক গীতালি চক্র বাসসে বলেছিলেন, রাসেল তাঁর সম্পর্ক ছিল বিচিত্র সূরে গাঁথা, সেখানে প্রচলিত সূর-তাল-লয় বা ছন্দের কোন বালাই ছিল না। ছিল নিত্য নব আনন্দ ও প্রগাঢ় ভালোবাসার শব্দহীন সম্পর্ক। ওর সম্পর্কে আমার মুখে ভাষান্তরিত করা যত সহজ, লেখা তত সহজ নয়। অনুভব গভীর হলে, ভাষা সেখানে ছন্দ্রহীন।

তিনি শীতের দিনের রাসেল’র অন্যায়ের প্রতিবাদের গল্প শুনান বাসসকে। কনকনে শীতের দিন।ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পাশের বাড়ির বন্ধু তাঁরও নাম রাসেল। একসাথে খেলাধূলা করতেন। দুই রাসেল ভালো বন্ধুও বটে। একদিন এক বুড়ি পাশের বাড়িতে ( তাঁর বাড়িতে)ভিক্ষা করতেন আসলেন। তারা বললেন, ভিক্ষা না, কাজ করলে এক টাকা দিব। বুড়িমাকে কাজ শেষ ২৫ পয়সা দিলেন। বুড়িমা কান্না করতে করতে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন। এই ঘটনায় শিশু রাসেলে’র মনে কষ্টের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়। বুড়িমাকে পরম যত্নে তুলে এনে গেটের সামনে বসিয়ে রাখেন। বলেন,আব্বা ( বঙ্গবন্ধু) আসলে কথা বলিযে দিব, তুমি বিচার চাইবা। দুপুরে তাকে খাবার দেয়, এদিক দিয়ে বুড়িমা শীতে জুবুথুবু খাচ্ছে।সবাই চিন্তিত বঙ্গবন্ধু কখন আসেন? আর এদিক দিয়া প্রচন্ড শীতে গেইটে থেকে বুড়িমার যদি কিছু হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর কথা একটাই আব্বা আসলে বিচার হবে। তারপর বুড়িমা যাবেন। সবাই উপায়ান্তর না দেখে রাসেলকে প্রস্তাব দিল বুড়িমাকে বেশী টাকা দিব এবং রাতের খাবার দিব তবু তার বাড়িতে যেতে দাও। সে প্রস্তাবে রাজি হল। তারপরও বাবা আসার সাথে সাথেই উক্ত ঘটনার বিচার দাবী করেছিল।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। তখন রাসেল ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। দিনটা ছিল শুক্রবার। কাক ডাকা ভোরে ৩২ নম্বর ঘাতকরা ঘিরে রেখেছে। জলপাই রঙের গাড়ীর গর্জনে নিস্তব্ধ হয়ে গেলে ঢাকার রাজপথ। রাসেল ঘুমভাঙা চোখে দেখেছিলেন, সবকটি গুলির শব্দও শুনেছিলেন। বাড়িতে নির্মম হত্যাকান্ডে রাসেল ভয়ে ভয়ার্ত হয়েছিলেন। আতঙ্কিত, ভযার্ত রাসেল’র দিকে ঘাতকরা অস্ত্র তাক করার সাথে সাথে বলেছিলেন,

” আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও, আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও। ”

ঘাতকরা ওয্যারলেসে অনুমতি নিয়েছে তাকে হত্যার করার। রাসেল’র দোষ ছিল একটাই সে বঙ্গবন্ধু’র কনিষ্ঠ পুত্র। ঘাতকরা রাসেলকে হত্যার আগে মানসিক ভাবে হত্যা করেছিল। নিষ্ঠুরতার সবটুকুই রাসেলকে স্বচক্ষে দেখিযেছিল। অবুঝ শিশুকে হাত ধরে তাঁর প্রিয়জনের রক্তমাখা দেহ দেখিয়েছিল। রাসেল বাকরুদ্ধ হয়ে তাঁর প্রিয় মানুষ গুলো, বড় ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, চাচা শেখ আবু নাসের, স্নেহময় বাবা শেখ মুজিব, মমতাময়ী মা,ভাবি ও রোজী সবার প্রাণহীন নিথর দেহগুলো দেখেন। রক্তাক্ত মেজে দিয়ে হাঁটতে রাসেল’র কষ্ট হচ্ছিল, সাথে বুকে জমে থাকা বুকফাটা আর্তনাথ। ঘাতকরা কেমন করে অবুঝ শিশুকে এমন বিভর্ষ দৃশ্য দেখালো! প্রিয়জনের রক্তমাখা দেহগুলো দেখে রাসেল’র হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। রাসেল তাঁর শেষ পরিণতি বুঝার বাকি ছিল না। ছোট্ট রাসেল শেষ বাঁচার অবদার করেছিল এই বলে, আমাকে আমার হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন। ঘাতকরা বুলেটে, বন্দুকের নল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। আর রাসেল চিৎকার করে বলেছিলেন, তোমরা আমাকে মেরো না, আমি বঙ্গবন্ধু পরিচয়ে বড় হবো না। তাঁর আত্বচিৎকারে বাংলার আকাশ বাতাস কম্পিত হয়েছিল কিন্তু ঘাতকের মন কম্পিত হয়নি। তারা রাসেলকে হত্যার মাধ্যমে তাদের অপারেশন শেষ করে। আমার অশ্রু জল আমার কলমকে থামিয়ে দিল।

মোঃ সাইদুর রহমান ,কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা

নান্দাইল, ময়মনসিংহ।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Our Like Page