বিশেষ প্রতিনিধি:
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৬তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ বাহিনীর কল্যাণে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। এদিন ডিএমপির নতুন কমিশনার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস পরিদর্শন করেন এবং ফোর্সের কল্যাণে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তার নেতৃত্বে এবার বদলে যাচ্ছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ব্যারাকে থাকা পুলিশ সদস্যদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
নবনিযুক্ত কমিশনার তার পরিদর্শন কার্যক্রমের প্রথমে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের স্মৃতিতে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর তিনি পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরে ফোর্সের বিভিন্ন ব্যারাক, মেস, রান্নাঘর ও জিমনেসিয়াম পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনকালে তিনি ব্যারাকে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি জনবান্ধব, আধুনিক ও মানবিক পুলিশ গঠনের লক্ষ্যে ফোর্সের কল্যাণ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বহুতল বিশিষ্ট আধুনিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ফোর্সের আবাসন সংকট নিরসনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পুলিশ লাইনসের মেসগুলো পরিদর্শনের সময় তিনি পুলিশ সদস্যদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এসময় তিনি ফোর্সের নিয়মিত খাদ্য তালিকায় মৌসুমি ফলের পরিমাণ বাড়াতে নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে খাবারের মান উন্নয়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের জিমনেসিয়াম পরিদর্শনকালে নবনিযুক্ত কমিশনার ফোর্সের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানসিক সুস্থতার জন্য শরীরচর্চার গুরুত্ব তুলে ধরেন। বাংলাদেশ পুলিশের খেলোয়াড়দের জন্য স্থাপিত জিমনেসিয়াম নিয়ে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং শিগগির ফোর্সের জন্য একই মানের একটি জিমনেসিয়াম স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানান।
এ সময় নবনিযুক্ত কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ফোর্সের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। পুলিশ ফোর্সের কল্যাণে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি।
ব্যারাকে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলেন, এই প্রথম কোন কমিশনার স্যার দায়িত্ব নিয়েই ব্যারাকে এসেছেন আমাদের খোঁজ নিতে। কোন পুলিশ কমিশনার স্যারই এভাবে আমাদের খোঁজ নিতে আসেননি। নতুন কমিশনার স্যারের কাছে কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। আশা করছি তিনি তা পূরণ করবেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) একেএম হাফিজ আক্তার, যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (হেডকোয়ার্টার্স) সাইফুল্লাহ আল মামুন এবং উপ-পুলিশ কমিশনার (ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড ফোর্স) আর এম ফয়জুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বিদায়ী কমিশনার গোলাম ফারুকের কাছ থেকে ৩৬ তম কমিশনার হিসেবে ডিএমপি সদর দপ্তরে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। দায়িত্বগ্রহণ শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানমন্ডি ৩২ এর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় জাদুঘরে রক্ষিত পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন নতুন এই কমিশনার। পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
গত ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে হাবিবুর রহমানকে ডিএমপির কমিশনার হিসেবে পদায়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান এরআগে টুরিস্ট পুলিশে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া ডিএমপির উপকমিশনার (সদর দপ্তর), ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জানা গেছে, কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে নিয়ে তার কাজ প্রশংসিত। তাছাড়া ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া হাবিবুর রহমান ১৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে।
শৈশব থেকেই তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। এসএম মডেল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
বিভিন্ন কর্মস্থলেই রেখেছেন সৃষ্টিশীল চিন্তা চেতনা আর ব্যতিক্রমী কর্মস্পৃহার সাক্ষর। তার প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। তিনি ডিসি হেডকোয়ার্টার্স থাকাকালীন তিনি বাংলাদেশ পুলিশের বাস্কেটবল এবং কাবাডি টিমের দায়িত্ব গ্রহণ করে পুলিশ টিমের খেলায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন।
এছাড়াও হাবিবুর রহমান ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে করোনাকালীন সমাজের নিম্নস্তরের ও পিছিয়ে থাকা মানুষদের সহায়তা, পুলিশ নিয়োগ ও পদায়নে স্বচ্ছতাসহ নানা সংস্কার করেন। যা অন্যান্য পুলিশ ইউনিটের জন্য অনুকরণীয় হিসেবে প্রকাশ পায়। দীর্ঘ তিন বছর ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানেও নানা পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে টুরিস্ট পুলিশকে এগিয়ে রেখেছেন।
হাবিবুর রহমানের বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন পরিবর্তনেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া যৌনপল্লির শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি দেশ জুড়ে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থান নির্মাণ করেছেন। পুলিশের চাকরির পাশাপাশি লেখালেখি-গবেষণাতেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। তার গবেষণা ও বিভিন্ন বিষয়ে লেখা অসংখ্য বই প্রকাশ হয়েছে।
তার হাত ধরে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’ এ টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়। যেখানে বিনামূল্যে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া হয়। তার আরেকটি মানবিক উদ্যোগ ‘পুলিশ ব্লাড ব্যাংক’ যা করোনা রোগীদের প্লাজমা এবং ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট সরবরাহ করে কোডিড-১৯ ও ডেঙ্গু চিকিৎসায় ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের মাসিক প্রকাশনা ‘দি ডিটেকটিভ’ সম্পাদনা করছেন। সাংস্কৃতিমনা হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। তার গবেষণা ও দিকনির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয়েছে জনপ্রিয় ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ ও ‘অচলায়তনের অপ্সরী’ নাটক ।
ডিএমপির নতুন এই কমিশনার বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সেক্রেটারি এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি। এ ছাড়া তার নেতৃত্বে দেশে বাংলাদেশ গেমস, যুব গেমস, জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা, আইজিপি কাপ জাতীয় যুব কাবাডি, প্রিমিয়ার কাবাডি লীগ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ কাবাডি লীগসহ অসংখ্য কাবাডি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে।