নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকার কোরবানির পশুর চামড়া প্রতি বর্গফুট হিসাবে দাম নির্ধারণ করে দিলেও রংপুরের মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়নি। গরুর লবণ যুক্ত কাঁচা চামড়া ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৪৮ টাকা।
রংপুর নগরীসহ আশপাশের উপজেলায় ব্যবসায়ীরা কৌশলে ১৫-২৫ টাকা প্রতি বর্গফুটে চামড়া ক্রয় করেছেন। এভাবে চামড়া কিনেছেন রংপুরের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা পুঁজি সঙ্কটে চামড়া কিনতে পারেননি। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করেছেন কোরবানির পশুর চামড়া। ব্যবসায়ীদের এমন অশুভ সিন্ডিকেটের ফাঁদে রংপুরে কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার আমদানি। সঙ্গে বেড়েছে অবিক্রিত চামড়া মাটিচাপা দেওয়ার ঘটনা।
বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগরীর শাপলা চত্বর চামড়াপট্টিতে আসা সাধারণ মানুষ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। চামড়া কেনার কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিতে পারেননি পুঁজি সংকটে থাকা ব্যবসায়ীরা। বকেয়া টাকা আদায় ও মূলধনের সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী এ ঈদে চামড়া কিনতে পারেননি। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী সেখানে গড়েছেন সিন্ডিকেট। তাদের কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিক্রেতা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
নজরুল ইসলাম তিনি রংপুর নগরীর সাহেবগঞ্জ তকেয়ার পাড় এলাকার বাসিন্দা রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, রিকশা ভাড়া করি এত দূর আসি লাভ কী? চামড়া যে এত সস্তা, তাক তো সরকার কয় নাই। গরুর চামড়ার দাম ৪০০ টাকা আর ছাগলের চামড়া দুইটা ১৫ টাকাত বিক্রি করা নাগিল। হামরা তো লাভ-লসের হিসাব করি না। কিন্তুক এটা যে গবীরের হক, সেটা কি ব্যবসায়ীরা বুঝে না। সরকার যে দাম বান্দি দেচে, সেই দাম হিসাব করি তো চামড়ার দাম কায়ো কয় না বাহে। অনেকটা ক্ষোভ আর হতাশা থেকে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।
চামড়া বিক্রির উদ্দেশ্যে অটোরিকশায় করে এসেছেন শাপলা চত্বর চামড়াপট্টি এলাকায়। রিকশাভাড়া ঘণ্টা প্রতি ১০০ টাকা ঠিক এসে ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে তার মেজাজ চড়া। কারণ একটি গরু ও আর দুটি খাসির চামড়া বিক্রি করতে তার সময় গেছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। বলতে থাকেন ‘যে দামে গরু কিনছি বাহে সেই হিসাবে তো গরুর চামড়া দাম পাইনো না। সোয়া লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম খালি ৪০০ টাকা পানু। আর ছাগল দুইটার চামড়া আনি মুই নিজে ছাগল হয়্যা গেচু। চামড়া কেনাইয়ারা সরকারের কথা মানে না। ওমরা নিজেরা ইচ্ছামতো দাম করি চামড়া কিনতোছে। ব্যবসায়ীর কোনো লোকসান নাই, যত লোকসান গরীবের। এমরা সগায় সিন্ডিকেট করি চামড়া কিনতোছে।’
রংপুর সদর উপজেলার পালিচড়া থেকে আসা বুদু মিয়া জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ী গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু গরুর চামড়া কিনছি। মোটামুটি চামড়ার মান ভালো, কিনতেও একটু বেশি পড়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে এসে লাভ তো দূরের কথা আসল (পুঁজি) টাকাই থাকছে না। একেকটা চামড়া কেনা পড়েছে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা। এখন বিক্রির দাম উঠেছে গড়ে ৭৫০ টাকা করে। ভাবছি বিক্রি না করে বাড়িতে নিয়ে লবণ দিয়ে রাখব।
চামড়া সংগ্রহকারী আব্দুল কুদ্দুস জানান, চামড়ার ব্যবসা আগের মতো নেই। দশ বারো বছর আগেও চামড়াপট্টিতে রমরমা ব্যবসা ছিল। এখন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী চামড়া কিনেছেন। তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে সিন্ডিকেট না হলেও অন্তরের চাওয়া-পাওয়ায় মিল ছিল। এ কারণে চামড়ার দাম খুব বেশি উঠেনি।
চামড়া কিনে বিপাকে পড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চামড়ার জন্য প্রসিদ্ধ রংপুরের চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীরাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও সস্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গরুর চামড়ায় দাম মিললেও ছাগলের চামড়া ফ্রি-তে দিতে হয়েছে। চামড়ার দাম কম দিতে নানা অযুহাতের ফাঁদ গল্প শুনতে হয়েছে তাদের। সঙ্গে এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট ও খারাপ আচরণের কারণে বাইরের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা এই এলাকায় আসতে পারেন না। এর প্রভাব পড়েছে চামড়ার দামে।
চামড়া ব্যবসায়ীদের দাবি, সিন্ডিকেট মফস্বল পর্যায়ে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া কিনতে পারেননি।
জানা গেছে, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন যারা বাপ-দাদার এই ব্যবসা ধরে আছেন তারা হাতে গোনা কয়েকজন।
চামড়া শিল্পে বিমুখ হয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের পথে বসিয়ে দিয়েছেন ঢাকার ট্যানারি মালিকরা। করোনা শুরুর আগের বছর থেকে ঢাকার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনে ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করেননি। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলেও সব পুঁজি রয়ে গেছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। বছরের পর বছর বকেয়া টাকা তুলতে না পেরে অনেকে আবার বাপ-দাদার আদি ব্যবসা ছেড়ে দেন অনেকেই।এখন চামড়া ব্যবসার সঙ্গে হাতেগোনা ১০-১২ জন ব্যবসায়ী জড়িত রয়েছেন।
রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল লতিফ খান জানান, চামড়া ব্যবসায়ীরা ঈদে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে চামড়া কিনেন। ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা চামড়া ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন। একদিকে পুঁজি সংকট আর অপরদিকে লবণের দাম বাড়ায় এবারও চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে এ নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ। দেশের প্রায় দুই শতাধিত ট্যানারির মধ্যে এখন মাত্র ১৫ থেকে ২০টি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারি করতে চাইছেন না।
তিনি আরও বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বর্তমানে সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউই ভালো দাম পাচ্ছেন না। এমনিতে দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।