নিজস্ব প্রতিবেদক: পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে দলের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতে হার্ডলাইনে বিএনপি। সিদ্ধান্ত অমান্য করলেই কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এ নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তবে তাকেও আমলে নিচ্ছেন না দলের অনেক নেতা। দলটি নির্বাচন বর্জন করলেও বেশ কিছু নেতা কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় মঙ্গলবার গাজীপুরে বিএনপির ২৯ নেতাকে বহিষ্কার করে ‘সতর্কবার্তা’ দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরে একটি সাংগঠনিক ইউনিটে এত বেশি সংখ্যক নেতাকর্মীকে বহিষ্কারের নজির নেই। এই কঠোর শাস্তিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না বাকি চার সিটির নেতারা।
সিটিগুলোর মধ্যে সিলেট ও বরিশালে বিএনপির বহু পদধারী নেতা নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে খুলনা ও রাজশাহীতে হাতেগোনা কয়েকজন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীর বেশিরভাগই বিএনপিপন্থি। তাঁদের অনেকে বর্তমানে একই পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা বলছেন, তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না চাইলেও এলাকার ভোটারদের চাপে বাধ্য হচ্ছেন প্রার্থী হতে। বরিশালে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির ১৮ নেতাকর্মী। অন্যদিকে খুলনায় বিএনপির ছয় নেতাকর্মী প্রার্থী হলেও তাঁদের মধ্যে পদধারী শুধু দু’জন। রাজশাহীতে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন বিএনপি সমর্থক দেড় ডজন নেতা। অবশ্য তাঁদের কেউই নেই দলীয় কমিটিতে। শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারেন কেউ কেউ।
দলটির নেতারা জানান, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এমনকি কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও যাবে না দলটি। এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় প্রথমে তাদের শোকজ করা হয়। কিন্তু এর পরও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্পৃক্ত থাকায় ওইসব নেতার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর আগে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মেয়র প্রার্থীদের বহিষ্কার করলেও কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিষয়ে নমনীয় ছিল। এবার দলের পদ-পদবি ব্যবহার করে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেই বহিষ্কার করা হচ্ছে।
গাজীপুরের মতো সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী না হতে এরই মধ্যে দলের ৩২ জন নেতাকে মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবার গত দুটি সিটি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে টানা দুবার মেয়র নির্বাচিত হওয়া আরিফুল হক চৌধুরীকেও প্রার্থী না হতে বলেছে দলটি। মূলত, দলের নির্দেশনার মধ্যে নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল সমকালকে বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে তাঁদের। এমনকি কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও তাঁরা যাবেন না। আর এটাই দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে দলের কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটাও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
সিলেটে ‘জনগণের চাপ’
সিলেট পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে বিএনপিদলীয় কাউন্সিলরদের ছিল দাপট। বর্তমান মেয়রও বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য। তিনি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর থেকে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তিনিও এবার প্রার্থিতা নিয়ে রয়েছেন দোটানায়। ২০ মে তাঁর প্রার্থিতার বিষয়টি স্পষ্ট করবেন বলে জানিয়েছেন।
৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে এখন পর্যন্ত সাধারণ ওয়ার্ডের ৩৩৮ প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। একইভাবে সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন ৯০ জন। এর মধ্যে অধিকাংশই বিএনপিপন্থি। বর্তমান পরিষদেও আছেন বিএনপিদলীয় ১২ কাউন্সিলর। তাঁদের অধিকাংশই বিএনপির পদবিধারী।
গত ১০ মে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে নগর কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। ওই সভায় কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে পারেন বা প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন ২৫ নেতার নাম কেন্দ্রে জমা দেন নগর কমিটির নেতারা। তাঁদের মধ্যে আটজনই বর্তমান কাউন্সিলর। চারজন সাবেক কাউন্সিলর। বাকিরা আগে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন বা প্রথমবারের মতো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য ফরহাদ চৌধুরী শামীম চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে সমকালকে বলেন, নগর বিএনপি তাদের দায়িত্ব পালন করেছে আমাকে চিঠি দিয়ে। আমিও কাউন্সিলর হিসেবে এখনও দায়িত্ব পালন করে চলেছি। এ পর্যন্ত আমি ৫ বার নির্বাচিত হয়েছি একমাত্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে। দল করি বলে অবশ্যই সেটি ফেলার নয়। তিনি বলেন, ওয়ার্ডবাসী আমাকে চায়। আমি কীভাবে আমার ওয়ার্ডবাসীকে বঞ্চিত করব?
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী সমকালকে বলেন, দলের এই সিদ্ধান্তকে আমি মেনে নিলেও আমার ওয়ার্ডের লোকজন মানবে না। আর আমিও জনগণকে কোনোভাবে বোঝাতে পারব না। আমি তাদের পাশে আছি।
বরিশালে সিনিয়র নেতারাও প্রার্থী:
বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সেলিম হাওলাদার ১৯৯৫ সালে তৎকালীন পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। এর পর টানা চারটি সিটি নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। তিনি টানা ২৮ বছর নগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হাটখোলা-বাজার রোড এলাকার জনপ্রতিনিধি।
আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য সিটি নির্বাচনে ফের কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন তিনি। দল নির্বাচনে নেই, তিনি কেন প্রার্থী হলেন– জানতে চাইলে সেলিম সমকালকে বলেন, ‘দলের চাইতে আমার কাছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদটি গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের যত সম্মান এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদ থেকেই পেয়েছি। দল যে সিদ্ধান্তই নিক, আমি নির্বাচনে থাকব।’
মহানগর কমিটির আরেক সদস্য সংরক্ষিত ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সেলিনা বেগম প্রার্থী থাকার বিষয়ে বলেন, আমাদের কাছে জনগণের অনেক আশা-ভরসা। আমরা জনগণকে অসহায় অবস্থায় ফেলে ঘরে উঠব না; তাতে দল যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন। তিনিও টানা ৩ মেয়াদ ধরে কাউন্সিলর।
এ নির্বাচনে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডে বিএনপির ১৮ জন নেতাকর্মী কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। দল বহিষ্কর করলেও তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ৭ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জামাল হোসেন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। অবশিষ্ট ৬ জনের মধ্যে ৫ জনই এবার প্রার্থী হয়েছেন। প্রার্থী না হওয়া একমাত্র বর্তমান কাউন্সিলর হলেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল ইসলাম। তিনি ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ২০০৩ সাল থেকে টানা চার মেয়াদ কাউন্সিলর। তবে পদহীন নেতার পাশাপাশি কমিটির ৩ জন যুগ্ম আহ্বায়কও প্রার্থী হয়েছেন।
খুলনায় পদধারী শুধু দুইজন
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির ৬ নেতাকর্মী। তবে তাঁদের মধ্যে পদধারী নেতা শুধু দুইজন। প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে তাঁদেরকে দল থেকে বহিষ্কারের চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। তবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন তাঁরা।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শেখ সাজ্জাদ হোসেন তোতন, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আশফাকুর রহমান কাঁকন, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. মাহবুব কায়সার, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি শমসের আলী মিন্টু, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি কর্মী ও সাবেক কাউন্সিলর মুহা. আমান উল্লহ আমান, সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাজেদা খাতুন প্রার্থী হয়েছেন।
সাজ্জাদ হোসেন তোতন বলেন, আমি আগে দুইবার বিএনপির মনোনয়ন বা সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করেছিলাম। গতবার অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হই। ওই নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। তিনি বলেন, এবার আমি নির্বাচন করবই; প্রার্থিতা থেকে সরব না। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিজয়ী হবো বলে আশাবাদী। দল বহিষ্কার করলে কী করার আছে? আশফাকুর রহমান কাঁকন বলেন, বিএনপির বর্জনের কারণে নির্বাচন করতে চাইনি। কিন্তু এলাকার জনগণ ছাড়েনি। সে কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব।
তবে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর হাফিজুর রহমান মনি এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হননি। তিনি মহানগর বিএনপির আহ্বয়ক কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। আমার সিদ্ধান্তে এলাকাবাসী কষ্ট পেয়েছে। আমি তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা জানান, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়া নেতাকর্মীর তালিকা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হচ্ছে।
রাজশাহীতে নেই দলীয় পদধারী কেউ
বিএনপি সমর্থক কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কাউন্সিলর এবারও রাজশাহী সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে তাঁদের কেউই দলীয় কোনো পদে নেই। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডে ১৫ থেকে ২০ জন বিএনপি সমর্থক কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। তবে তাঁদের কেউই বিএনপি বা তার সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটিতে নেই।
২০১৮ সালের রাজশাহী সিটি নির্বাচনে বিএনপি সমর্থক চারজন কাউন্সিলর প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সোবহান লিটন, ১৬ নম্বর কাউন্সিলর বেলাল আহমেদ, ২৭ নম্বর কাউন্সিলর আনোয়ারুল আমিন আজম ও ২৮ নম্বর কাউন্সিলর আশরাফুল আলম বাচ্চু। তবে ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করে বিএনপি।
১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সোবহান লিটন বলেন, ‘দলে আমার কোনো পদ নেই। আমি বিএনপির একজন সমর্থক মাত্র। এটা তো প্রতীকের ভোট না। জনসেবামূলক কাজ। স্থানীয় মানুষকে ভালোবেসে তাদের সেবা করতেই এই ভোট করি।’ তিনি আরও জানান, বিএনপি থেকে গতবার নির্বাচিত বর্তমান কাউন্সিলর এবং সাবেক কাউন্সিলর সবাই এবারও নির্বাচন করছেন।
এ বিষয়ে মহানগর বিএনপি সভাপতি এরশাদ আলী ঈশা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিএনপির কোনো নেতা নির্বাচন করছেন না। আমাদের সমর্থক বা সাবেক নেতা যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁদের আমরা নিষেধ করব।’
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সমকাল প্রতিবেদক কামরুল হাসান, সিলেট ব্যুরোর ফয়সল আহমদ বাবলু, বরিশাল থেকে সুমন চৌধুরী, খুলনা ব্যুরোর মামুন রেজা ও রাজশাহীর সৌরভ হাবিব।