শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বিজ্ঞপ্তি
ভারতের ‘পবিত্রতম’ গঙ্গায় উপচে পড়ছে লাশ, ভয়ঙ্কর কাহিনী
Update : বৃহস্পতিবার, ২০ মে, ২০২১, ২:৪৮ অপরাহ্ন

নিউজ ডেস্ক: ভারতের হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পবিত্রতম নদী গঙ্গায় বেশ কিছু দিন ধরে উপচে পড়ছে লাশ আর লাশ। শত শত লাশ গঙ্গার স্রোতে ভেসে এসেছে অথবা এর তীরে বালিতে চাপা দেয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। দেশটির উত্তরপ্রদেশের যেসব জায়গায় নদী তীরে এই দৃশ্য দেখা গেছে, সেখানকার মানুষের ধারণা এগুলো করোনায় মারা যাওয়া মানুষের লাশ। এপ্রিল থেকে করোনা বা কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ভারত।

দেশটিতে এ পর্যন্ত আড়াই কোটির বেশি মানুষের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে দুই লাখ ৭৫ হাজারের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে এই ভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আসলে এর কয়েকগুণ বেশি।

নদী তীরে খুঁজে পাওয়া লাশ, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বলতে থাকা চিতাগুলো ও শ্মশানে জায়গার অভাব- এসব কিছু থেকে ভারতে মোট মৃত্যুর এমন একটি সংখ্যার আভাস পাওয়া যায়, যা সরকারি পরিসংখ্যানে স্বীকার করা হচ্ছে না।

উত্তরপ্রদেশের সবচেয়ে বেশি সঙ্কটজনক অবস্থা যেসব জেলায়, সেখানকার স্থানীয় রিপোর্টার, সরকইর কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলেছে বিবিসির প্রতিবেদক। গঙ্গায় ভেসে থাকা লাশের পেছনে লুকিয়ে আছে সনাতনী বিশ্বাস, দারিদ্র্যতা আর এমন এক ভয়ঙ্কর মহামারীর গল্প, যা এখন বিদ্যুৎ গতিতে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।

বিস্তীর্ণ নদীচরজুড়ে যখন কেবল সমাধি
উত্তরপ্রদেশের এই ভয়ঙ্কর চিত্র প্রথম প্রকাশ পায় ১০ মে, যখন ৭১টি লাশ বিহার সীমান্তের কাছে চাউসা গ্রামের নদী তীরে ভেসে আসে। চাউসা গ্রামটি বাক্সার জেলায়। সেখানকার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট নীরাজ কুমার সিং বিবিসিকে বলেন, পচে যাওয়া এসব লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপর নদী তীরের গর্তে এগুলো কবর দেয়া হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, নদী তীরে লাশ দাহ করার পর যেসব দেহ খণ্ড পড়ে ছিল, ওইগুলোই হয়তো নদীতে ভেসে গিয়েছিল। কিছু দেহাবশেষ হয়তো এরকম কিছু। তবে তাদের সন্দেহ লাশগুলো হয়তো নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এরকম ভেসে আসা আরো লাশ আটকানোর জন্য পুলিশ নদীতে একটি জালও পেতেছে।

এর এক দিন পর চাউসা গ্রাম হতে ছয় মাইল দূরে উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর জেলার গাহমার গ্রামের কাছে নদী তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায় একেবারে পচে যাওয়া কয়েক ডজন বিকৃত লাশ। বেওয়ারিশ কুকুর ও কাকের খাদ্য হয়ে উঠেছিল এসব লাশ।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরেই নদী তীরে এরকম লাশ ভেসে আসছিল। এখান থেকে যে পচা গন্ধ ছড়াচ্ছিল এ ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অভিযোগ আমলে নেয়নি। এরপর যখন গঙ্গার ভাটিতে বিহারে অনেক লাশ পাওয়ার খবর সংবাদ শিরোনাম হলো, তখনই কেবল কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসলো।

পাশের জেলা বালিয়াতেও ঘটলো একই ঘটনা। সেখানে গ্রামবাসীরা যখন গঙ্গায় সকালে স্নান করতে গেলেন, তখন দেখলেন ডজন ডজন পচে ফুলে ওঠা লাশ নদীতে ভাসছে। ভারতের হিন্দুস্থান পত্রিকার খবর অনুযায়ী পুলিশ ৬২টি লাশ উদ্ধার করে।

কান্নাউজ, কানপুর, উন্নাও এবং প্রয়াগরাজে নদীর তটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু অগভীর কবর। কান্নাউজের মেহন্দি ঘাটের তীর থেকে বিবিসির কাছে পাঠানো এক ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষের শরীরের আকৃতির সমান বহু ঢিবি। অনেকগুলো দেখতে নদীর চড়ায় ফুলে উঠা কিছুর মতো। কিন্তু এগুলোর প্রতিটিতেই লুকিয়ে আছে একটি করে লাশ। কাছের মাহদেভি ঘাটে অন্তত ৫০টি লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে।

মৃত্যুর সংখ্যায় ব্যাপক গরমিল
ভারতে হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে সাধারণত লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘জল প্রবাহ’ বলে একটি রীতিও প্রচলিত। শিশু, অবিবাহিত মেয়ে কিংবা সংক্রামক রোগে বা সাপের কামড়ে মারা যাওয়া কোনো ব্যক্তির লাশ নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় এই রীতিতে।

অনেক দরিদ্র পরিবার লাশ দাহ করার আর্থিক সামর্থ্য রাখে না। কাজেই তারা প্রিয়জনের দেহ সাদা মসলিন কাপড়ে মুড়ে নদীতে ফেলে দেয়। অনেক সময় লাশের সাথে পাথর বেঁধে দেয়া হয়, যাতে এটি পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু অনেক লাশ এমনিতেই পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। স্বাভাবিক সময়েও গঙ্গায় লাশ ভেসে আসার ঘটনা বিরল কোনো দৃশ্য নয়। তবে যেটা বিরল, তা হলো এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যায় লাশ ভেসে আসার ঘটনা।

কানপুরের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে জানিয়েছেন, করোনায় মৃতের সরকারি সংখ্যার সাথে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যার একটা বিরাট গরমিল আছে। এসব লাশ তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, সরকারি হিসেবে কানপুরে ১৬ এপ্রিল হতে ৫ মে পর্যন্ত ১৯৬ জন মারা গেছে। কিন্তু সাতটি ক্রিমেটোরিয়ামের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, সেখানে আট হাজার লাশ দাহ করা হয়েছে।

‘এপ্রিল মাসে সব ক্রিমেটোরিয়াম দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা চলছিল। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট ছিল না। কাজেই প্রশাসন ক্রিমেটোরিয়ামের বাইরের খোলা মাটিতে কাঠ দিয়ে লাশ পোড়ানোর ব্যবস্থা করে’, বরেছেন তিনি।

ওই সাংবাদিক বলেন, ‘কিন্তু তারা কেবল সেসব লাশই গ্রহণ করছিল যেগুলো হাসপাতাল থেকে করোনায় মারা গেছে বলে সার্টিফিকেট ছিল। অথচ বিরাট সংখ্যায় রোগী মারা যাচ্ছিল বাড়িতে, যাদের কোনো টেস্ট পর্যন্ত করা হয়নি। এদের পরিবার লাশ নিয়ে গেছে শহরের বাইরে কিংবা পাশের জেলা উন্নাওতে। যখন তারা কোনো চিতার ব্যবস্থা করতে পারেনি বা দাহ করার জন্য কাঠ পায়নি, তখন নদীর চরে নিয়ে লাশ চাপা দিয়ে রেখেছে।’

প্রয়াগরাজের একজন সাংবাদিক বলেন, তার বিশ্বাস বেশিরভাগ লাশ ওই মানুষের, যারা ঘরে করোনায় মারা গেছেন কোনো রকমের পরীক্ষা ছাড়া। অথবা যারা গরীব, লাশ দাহ করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই।

তিনি আরো বলেন, ‘এটা খুবই হৃদয়বিদারক। এরা কারও সন্তান, কন্যা, ভাই, বাবা কিংবা মা। মৃত্যুর পর এতটুকু শ্রদ্ধা অন্তত তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তারা মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পর্যন্ত জায়গা পাননি। তারা অজ্ঞাতসারে মারা গেছেন। তাদের কবরও দেয়া হয়েছে অজ্ঞাতসারে।’

দিনরাত অবিরাম কবর দেয়ার কাজ
নদী তীরে এসব কবর ও তার মধ্যে পচা লাশ যখন খুঁজে পাওয়া গেল, তা যেন নদী বরাবর গ্রামগুলোতে বিরাট আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। কারণ তাদের আশঙ্কা এসব লাশ থেকে হয়তো তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে।

‘গঙ্গা খুবই পবিত্র নদী’
গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয়ে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটি। হিন্দুদের কাছে এই নদী খুবই পবিত্র। তাদের বিশ্বাস এই নদীর পানিতে স্নান করলে তাদের পাপ ধুয়ে যায়। এই নদীর পানি তারা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্যও ব্যবহার করে।

কান্নাউজের ৬৩ বছর বয়সী জগমোহন তিওয়ারি স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলকে বলেন, তিনি নদীর চড়ায় ১৫০-২০০টি কবর দেখেছেন। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সেখানে কবর দেয়া হচ্ছিল। এটা ছিল হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মতো একটা দৃশ্য।

এসব কবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজনের ভয় ছিল, নদী তীরে কোনোরকমে মাটি চাপা দেয়া এসব লাশ যখন বৃষ্টি হবে বা নদীর পানি বাড়বে, তখন স্রোতে ভেসে যাবে।

বুধবার উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকার এরকম ‘জল প্রবাহ’ নিষিদ্ধ করেছে। একইসাথে যেসব গরীব পরিবার লাশ দাহ করার সামর্থ্য রাখে না, তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। অনেক জায়গাতেই পুলিশ নদী থেকে লাঠি দিয়ে লাশ টেনে তুলছিল। নদীতে মাঝিদের সাহায্য নিয়ে এসব লাশ তীরে টেনে আনছিল। সেখানে এসব লাশ খাদে ফেলে কবর দেয়া হয় অথবা চিতায় তুলে দাহ করা হয়।

বালিয়া জেলার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ভিপিন টাডা বলেন, তারা গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতাদের সাথে কথা বলছিলেন, যেন নদীতে লাশ ভাসিয়ে না দেয়ার জন্য তাদের সচেতন করা যায়। যাদের লাশ দাহ করার সামর্থ্য নেই, তারা যেন আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করে।

গাজিপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মঙ্গলা প্রসাদ সিং বিবিসিকে বলেন, পুলিশের দল এখন নদী তীরে ও শ্মশানঘাটে টহল দিচ্ছে। যাতে কেউ নদীতে লাশ ফেলতে না পারে বা নদী তীরে কবর দিতে না পারে। কিন্তু তার দল এখনো প্রতিদিন নদীতে দুই একটা লাশ খুঁজে পাচ্ছেন।

‘আমরা তাদের শেষকৃত্য পালন করছি। রীতি অনুযায়ী যেভাবে করার কথা’, বলছেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Our Like Page