নিজস্ব প্রতিবেদক:ভালো নেই দেশের শ্রমিকরা। যে টাকা আয় করছেন, তা দিয়ে সংসার একেবারেই চলছে না। এছাড়াও কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের অভাব এবং দেশের অর্থনৈতিক নানা সংকটে প্রতিনিয়ত কাজ হারাচ্ছেন। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ। ন্যূনতম মজুরি নেই ৫০টির বেশি খাতে। কর্মস্থলে কাজের নিরাপত্তা নেই। ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্য আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। অন্যদিকে করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এতে দুর্দিন যাচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকদেরও।
আন্তর্জাতিক সংস্থাও চলতি ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থাৎ আগামীতে ভালো দিন আসছে, এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো শ্রমঘন শিল্প প্রধান দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেশে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার। কিন্তু সরকার বলছে বেকার মাত্র ২৬ লাখ। পর্যায়ক্রমে আরও কমছে।
জানা গেছে-দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই শ্রমিক। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছেন। শ্রমিকের ওপর ভর করেই শক্তিশালী হচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির আকার বড় হলেও আয়ে বৈষম্য ব্যাপক। এই বৈষম্য কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতির যে হিসাব ছিল, করোনা সবকিছুই পালটে দিয়েছে। শ্রমিকদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। তার মতে, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি হলো বেশিরভাগ মানুষ কর্মক্ষম। এদের মজুরিও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম। তবে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে শ্রমিকদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। জনশক্তি এখনো সম্পদে পরিণত হয়নি। ফলে শ্রমিকদের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগানো যায়নি। তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। এ কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি। এ অবস্থার উত্তরণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে এই জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানা গেছে-শ্রম আইন ২০০৬ সালের ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে, শ্রমিক হলো ওই ব্যক্তি, যিনি তার চাকরির শর্ত পালন করে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরি কাজে নিযুক্ত। এছাড়া ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজে নিয়োজিতদেরও শ্রমিক বলা যাবে।
মূলত শ্রমিকদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো-অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) যেমন দোকানপাট, ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষিকাজ ইত্যাদিকে বিবিএস চিহ্নিত করেছে। আর আনুষ্ঠানিক (ফরমাল) ক্ষেত্র হলো-সরকারি অফিস-আদালত, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। আবার মোট শ্রমিকের মধ্যে ৮৭ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে। বাকি ১৩ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে। পেশার দিক থেকে কৃষক, মৎস্যজীবীর সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তির জরিপ অনুসারে বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এরমধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। গত ৫ বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা কমে ২৬ লাখ ৩০ হাজারে নেমেছে। ২০১৬ সালে যা ছিল ২৭ লাখ। এসব ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ পাননি। তবে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সি শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ কোটি ৬৯ লাখ। দেশের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মতে এ মানুষগুলো বেকার। কিন্তু এদের বেকার বলতে রাজি নয় বিবিএস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদণ্ড অনুযায়ী, সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসাবে ধরা হয়। বেসরকারি গবেষনা প্রতিষ্ঠান সিপিডির হিসাবে প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ নতুন শ্রমিকদের বড় অংশই বেকার থেকে যাচ্ছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে সেবা খাতের অবদান ৫৬ শতাংশ, শিল্পের ৩৩ এবং কৃষি খাতের ১৩ শতাংশ। আবার জিডিপির সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যোগ করলে হয় জাতীয় আয়। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পড়ে। অর্থনীতির এ অর্জনের পেছনে শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে নতুন কর্মশক্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি মৌলিক শক্তির মধ্যে রয়েছে কৃষি, রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টম। তিনটি শক্তির সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। তৈরি পোশাক, কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে প্রতিদিনই নতুন শ্রমশক্তি আসছে। এরাই তাদের মেধা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা সেভাবে মজুরি পাচ্ছেন না।
এখনো দেশে ৫০টির বেশি খাতে ন্যূনতম মজুরি নেই। ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির বিশাল পার্থক্য। কোনো খাতের মজুরি ২ হাজার টাকা, আবার কোনো খাতে ১৬ হাজার টাকার বেশি। তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ অটোমোবাইল ৫ হাজার ৯৩০ টাকা, জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং ৪ হাজার ৮৫০, হোমিওপ্যাথ কারখানা ৫ হাজার ২০১ টাকা, ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল ৩ হাজার, সিকিউরিটি সার্ভিস ৮ হাজার ৭২০, দর্জি কারখানা ৪ হাজার ৮৫০, অয়েল মিল অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রডাক্ট ৭ হাজার ৪২০, ক্লোল্ড স্টোরেজ ৬ হাজার ৫০, ওষুধ শিল্প ৮ হাজার ৫০, রাবার শিল্প ৪ হাজার ৯৫০, সিনেমা হল ২ হাজার ৬১০, আয়ুর্বেদিক কারখানা ৪ হাজার ৩৫০, বেকারি বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি ৫ হাজার ৯৪০, জাহাজ ভাঙা ১৬ হাজার, প্লাস্টিক শিল্প ৮ হাজার, মৎস্য শিকারি ও ট্রলার শিল্প ৫ হাজার ২শ, কটন টেক্সটাইল ৫ হাজার ৭১০, আয়রন ফাউন্ড্রি ৪ হাজার ২৪০, হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ ৩ হাজার ৭১০, সাবান ও কসমেটিকস ৫ হাজার ৬৪০, রাইস মিল ৭ হাজার ৮১০, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা কারখানা ৮ হাজার ৭শ, নির্মাণ ও কাঠশিল্প ১৬ হাজার ২৪০, স মিল ১৭ হাজার ৯শ, সড়ক পরিবহণ ১০ হাজার ১শ, রিরোলিং মিলস ১০ হাজার ৬৫০, প্রিন্টিং প্রেস ৮ হাজার ১৫০, চা শ্রমিক ৪ হাজার ৫শ টাকা, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল ৮ হাজার ৭শ, হোসিয়ারি ৪ হাজার ৬৫০ এবং চিংড়ি শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৬ হাজার ৭শ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মজুরি দিয়ে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন।
পোশাক খাতে সবচেয়ে কম মজুরি বাংলাদেশে : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণা অনুসারে পোশাক খাতে সবচেয়ে কম মজুরি বাংলাদেশে। বর্তমানে এখানে ৩২ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিটি শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ৮ হাজার টাকা বা ৭৫ মার্কিন ডলার। প্রতিযোগী দেশগুলোতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫-৩০ হাজার টাকা। গবেষণায় বলা হয়, তুরস্কে গার্মেন্টস খাতে মোট শ্রমিক ৪০ লাখ। তাদের মাসিক মজুরি ৩০৭ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩০ হাজার টাকা। ভিয়েতনামে গার্মেন্টস শ্রমিক ২৫ লাখ। ন্যূনতম মজুরি ১৬৮ ডলার। ফিলিপাইনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৪৪ ডলার। মালয়েশিয়ায় ২৭০ ডলার, কলম্বিয়ায় ১৯৪ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩৭ ডলার, ভারতে গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে সাড়ে ৪ কোটি শ্রমিক। তাদের ন্যূনতম মজুরি ১২৮ ডলার। চীনে গার্মেন্টস শ্রমিক ১ কোটি ৬০ লাখ। তাদের মজুরি ২৬২ ডলার। এ কারণে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২০২ ডলার বা ২২ হাজার টাকা করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। গবেষণায় ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-ঢাকায় চারজনের একটি শ্রমিক পরিবারে মাসিক খাবার বাবদ খরচ হয় ১৪ হাজার ৩৩০ টাকা, ঘর ভাড়া বাবদ খরচ ১০ হাজার টাকা, খাদ্য ও ভাড়াবহির্ভূত ব্যয় ৭ হাজার ৪৪৯ টাকা, চিকিৎসা ব্যয় ১ হাজার ২৮৭ টাকা, শিক্ষা ব্যয় ১ হাজার ২৫৬ টাকা, পোশাকসহ অন্যান্য ব্যয় ৪ হাজার ৯০৬ টাকা এবং মাসিক সঞ্চয় ১ হাজার ৫৮৯ টাকা। সব মিলিয়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৩৬৮ টাকা। তবে অধিকাংশ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কাজ করেন। তাই মজুরি ২২ হাজার টাকা হওয়া উচিত।
এদিকে বর্তমানে সব খাতের শ্রমিকের দুর্দিন চলছে। এর অন্যতম কারণ জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, ওইভাবে আয় বাড়েনি। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ। কিন্তু বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে তা ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যয়ের সঙ্গে সমানভাবে আয় বাড়ছে না। এছাড়াও দেশে নতুন বিনিয়োগ নেই। ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে টিকে থাকাই কঠিন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুসারে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের এই সংস্থা বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট আর দেখা দেয়নি।
জানতে চাইলে উন্নয়ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, আমরা জনশক্তি বোনাস পেয়েছি। এটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু মূল কথা হলো জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান দরকার। তিনি বলেন, জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে হবে।