যানজট এড়িয়ে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণমুখী যানবাহনের যাতায়াত নিশ্চিত করতে চালু হচ্ছে দ্রুতগতির প্রথম উড়ালসড়ক (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে)। উড়ালসড়কে যানবাহন ওঠানামা করার নির্ধারিত স্থান আছে। টোল প্লাজা ছাড়া চার লেনের এই উড়ালসড়কের কোথাও যানবাহন থামানো যাবে না।
দ্রুতগতির এই উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। আজ শনিবার কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশে চলাচল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর আগামীকাল রোববার সকাল ছয়টা থেকে সাধারণ যানবাহন চলাচল করতে পারবে। আর তেজগাঁও থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত বাকি অংশ আগামী বছরের জুনে চালু করার লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার।
পুরো উড়ালসড়কে ৩১টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠানামা (র্যাম্প) করার ব্যবস্থা থাকছে। র্যাম্পসহ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার। উড়ালসড়কে ১১টি টোল প্লাজা থাকছে। পুরো পথ চালু হলে তা যানবাহনে পাড়ি দিতে ২০ মিনিট লাগবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কাওলা থেকে তেজগাঁও অংশ পাড়ি দিতে লাগবে ১২ মিনিট।
আজ বিকেল চারটায় আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন ও মোনাজাতে অংশ নেবেন। এরপর সেখানে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
২০০৫ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুমোদন করেছে সরকার। পরে ২০১৫ সালে তা হালনাগাদ করা হয়। এই পরিকল্পনায় ঢাকার যানজট নিরসনে মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক, বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণসহ নানা প্রস্তাব রয়েছে। সরকার এই পরিবহন পরিকল্পনা ধরে ঢাকা ও এর আশপাশে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঢাকার উড়ালসড়ক প্রকল্পটিও সেই পরিকল্পনার অংশ।
আজ চালু হতে যাওয়া কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশের দূরত্ব সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৫টি স্থানে ওঠানামা করার ব্যবস্থা আছে। বিমানবন্দর এলাকায় দুটি, কুড়িলে তিনটি, বনানীতে চারটি, মহাখালীতে তিনটি, বিজয় সরণিতে দুটি ও ফার্মগেট এলাকায় একটি ওঠানামার জায়গা আছে। তবে মহাখালী ও বনানী ১১ নম্বর দিয়ে নামার পথ দুটি পরে চালু হবে।
উড়ালসড়ক দিয়ে আট ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। এর মধ্যে রয়েছে বাস, মিনিবাস, কার (সেডান), মাইক্রোবাস, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি যা জিপ নামে পরিচিত), কয়েক ধরনের পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপ। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার যান ও বাইসাইকেল চলাচল করতে পারবে না। চলতে পারবেন না পথচারীরা। এই উড়ালসড়কে চলাচলের জন্য যানবাহনের মালিককে টোল দিতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে টোলহার নির্ধারণ করেছে। কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ছয়টি টোল প্লাজা রয়েছে।
নকশা অনুসারে, উড়ালসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। তবে কাওলা থেকে তেজগাঁও অংশে আপাতত যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
যে যে পথে ওঠানামা
উড়ালসড়কের কোন কোন স্থান দিয়ে ওঠানামা করা যাবে, তা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সেতু বিভাগ। তালিকা অনুসারে, উত্তর দিক থেকে কাওলা, প্রগতি সরণি ও বিমানবন্দর সড়কে আর্মি গলফ ক্লাবের সামনে—এই তিন জায়গা দিয়ে উড়ালসড়কে ওঠা যাবে। নামার স্থানগুলো হচ্ছে বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, ফার্মগেটে ইন্দিরা রোডের পাশে।
দক্ষিণ দিক থেকে ওঠা যাবে বিজয় সরণি উড়ালসড়কের উত্তর ও দক্ষিণ লেন দিয়ে এবং বনানী রেলস্টেশনের সামনে থেকে। দক্ষিণ দিক থেকে উঠে নামা যাবে মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, বনানী কামাল আতাতুর্ক সড়কের সামনে বিমানবন্দর সড়কে, কুড়িল বিশ্বরোড ও বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সামনে।
সেতু বিভাগের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উড়ালসড়কে যানবাহন থেকে নেমে ছবি তোলা নিষেধ। মূল উড়ালসড়কে ওঠানামার জন্য র্যাম্পে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের (পিপিপি) ভিত্তিতে ঢাকার দ্রুতগতির উড়ালসড়কের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। সরকারের পক্ষে সেতু বিভাগ জমি দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করছে। পরামর্শকদের পেছনে ব্যয়ও করছে। নির্মাণকাজের ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ বহন করছে থাইল্যান্ড ও চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ২৭ শতাংশ বাংলাদেশের। চুক্তি অনুসারে, ২৫ বছরে (সাড়ে তিন বছর নির্মাণকাল বাদে) টোল থেকে আয় করে বিনিয়োগকারী পুঁজি ও মুনাফা তুলে নেবে। এরপর তা বাংলাদেশ সরকারের মালিকানায় ছেড়ে দেবে।
ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত। মূল নির্মাণকাজ এবং সহযোগী কাজ। মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা সরকার ব্যয়ন করছে। বাকিটা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান খরচ করছে।
এর বাইরে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পরামর্শকদের পেছনে ব্যয়ে আলাদা একটি প্রকল্প আছে। এর পুরো অর্থই ব্যয় করছে সরকার। বর্তমানে এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দুটি প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
প্রকল্প যেভাবে এগিয়েছে
২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। তবে পথ চূড়ান্ত করা ও নকশা প্রণয়নে দুই বছর ব্যয় হয়। থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে নির্মাণ চুক্তি সই হয় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাড়ে তিন বছরে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও পাঁচবার সময় বাড়ানো হয়।
ইতাল-থাই কোম্পানি পরে চীনের আরও দুটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে। এগুলো হচ্ছে চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন এবং সিনো হাইড্রো করপোরেশন। আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরুর সময় ধরা হয় ২০২০ সালে।
এর আগে ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ৪৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি করে তারা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না থেকে আরও ৪০০ মিলিয়ন ঋণ নেয়। সব মিলিয়ে প্রকল্পের বিপরীতে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি করে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে চুক্তির অর্ধেক ঋণ ছাড় করেছে দুটি ব্যাংক। চীনা প্রতিষ্ঠান যুক্ত এবং ব্যাংকঋণ পাওয়ার পরই কাজে গতি আসে।